সাংবাদিক আনিস আলমগীর ৫ দিনের রিমান্ডে, সম্পাদক পরিষদের নিন্দা

: যথাসময় ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ ঘন্টা আগে

ডেকে নিয়ে প্রায় ২৪ ঘণ্টা গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে রাখার পর সাংবাদিক আনিস আলমগীরকে এবার পাঁচদিন হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ পেল পুলিশ। রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলায় সোমবার গ্রেপ্তার দেখানোর পর বিকেলে তাকে সাত দিনের জন্য রিমান্ডে চেয়ে আবেদন করা হয় ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। শুনানির পর অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জশীতা ইসলাম পাঁচদিন রিমান্ডের আদেশ দেন। এদিকে,  কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই সাংবাদিক আনিস আলমগীরকে রবিবার (১৪ ডিসেম্বর) ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ।

রিমান্ড শুনানিতে তিনি আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি সাংবাদিক। আমি ক্ষমতাকে প্রশ্ন করি। দুই যুগ ধরে আমি এটা করে এসেছি। আমার জব (কাজ) কারও কাছে নতজানু হওয়া না। আমাকে যারা নির্দিষ্ট দলের গোলাম বানাতে চায়, এটা তাদের সমস্যা। আমার ফেসবুকে সব বক্তব্য দিই। এখানে অপ্রকাশিত নেই কোনো কিছু। আমি ইউনূসের (প্রধান উপদেষ্টা) বাড়ি আক্রমণের কথা বলেছি। কিন্তু কোন কারণে বলেছি, ৩২–এ আক্রমণ এটা প্রতিহিংসার রাজনীতি। এটা ফিরে আসবে। সেটা বলেছি। জুলাইয়ের স্পিরিট কীভাবে বাড়বে, আমরা সেটা বলেছি। এখানে আমার ভুল কী হয়েছে, আমি জানি না। আমার সঙ্গে কারও যোগসূত্র নেই। ড. ইউনূস যদি চায়, সারা বাংলাদেশকে কারাগার বানাবে, বানাতে পারে।’

ঢাকা মহানগরের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুক জানান, রিমান্ডের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ শুনানি করে। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি নিয়ে বিচারক পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এ মামলায় পুলিশ আনিস আলমগীরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশ পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান রিমান্ডের আবেদন করেন। বিকেল ৫টা ৮ মিনিটে তাকে আদালতের হাজতখানায় আনা হয়।

আনিস আলমগীরকে রোববার সন্ধ্যায় ডেকে নেওয়া হয়েছিল গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে। রাতভর তাকে সেখানেই রাখা হয়েছিল। তবে রিমান্ড আবেদনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশ পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, সময়স্বল্পতার কারণে আনিস আলমগীরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি।

মামলার অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্যও আনিস আলমগীরকে রিমান্ডে নেওয়া প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান। রিমান্ড আবেদনে তিনি বলেন, আসামির সহযোগী অন্যান্য পলাতক আসামিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে তাকে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করলে পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে। ঘটনায় আরও কেউ জড়িত আছেন কি না, তা-ও জানা যাবে।

আনিস আলমগীরের বিরুদ্ধ মামলাটি করেছেন ‘জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স’ নামের একটি সংগঠনের কেন্দ্রীয় সংগঠক আরিয়ান আহমেদ। গতকাল রাত ২টার দিকে উত্তরা পশ্চিম থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে এই মামলার আবেদন করেন তিনি। আনিস আলমগীরের পাশাপাশি অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনসহ আরও কয়েকজনকে আসামি করেন তিনি।

তার আগেই গতকাল সন্ধ্যায় আনিস আলমগীরকে ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া হয়। তিনি তখন ধানমন্ডি এলাকার একটি ব্যয়ামাগারে ছিলেন। তবে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা মুখ খুলছিলেন না।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মো. শফিকুল ইসলাম জানান যে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় আনিস আলমগীরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে রিমান্ডের আবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা গতকাল সন্ধ্যায়ই আনিস আলমগীরকে গ্রেপ্তারের কথা উল্লেখ করেছেন।
রিমান্ড আবেদনে আরও বলা হয়, আনিস আলমগীর এক মাস আগে সময় টিভির এক টকশোতে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের অপ্রকাশিত নেতারা সরকারকে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে।’

আনিস আলমগীর সম্প্রতি টিভি টকশোতে তার বক্তব্যের জন্য আলোচনায় ছিলেন। আজকের কাগজের এক সময়ের এই বিশেষ প্রতিনিধি পরে মানবকণ্ঠের সম্পাদক হয়েছিলেন, টেলিভিশনেও কাজ করেছেন। এখন তিনি কোনো সংবাদমাধ্যমে যুক্ত নেই, শিক্ষকতা করছেন।

আনিস আলমগীরের বিরুদ্ধে মামলার অন্য আসামি মেহের আফরোজ শাওন, ইমতুরা তিশ ইমতিয়াজসহ অন্যদের ফেসবুক পোস্ট নিয়ে অভিযোগ তোলা হয়েছে। রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, উল্লিখিত আসামিরাসহ অন্যান্য আসামি পরস্পর যোগসাজশে তাঁদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল হতে বিভিন্ন প্রকার উসকানিমূলক পোস্ট ও বক্তব্য দিয়ে দেশের জননিরাপত্তা বিপন্ন করা, অন্য ব্যক্তিকে হত্যার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা এবং অন্য ব্যক্তিকে হত্যা-গুরুতর জখম করার ষড়যন্ত্র ও সহায়তা করার জন্য প্ররোচিত করেন।

মামলার ঘটনায় সম্পাদক পরিষদের নিন্দা :

কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই সাংবাদিক আনিস আলমগীরকে রবিবার (১৪ ডিসেম্বর) ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ। সোমবার সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নূরুল কবির ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ এক বিবৃতিতে এই নিন্দা জানান।

এতে বলা হয়, গতকাল রবিবার কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই সাংবাদিক আনিস আলমগীরকে ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া হয়। তাকে সেখানে আটকে রেখে পরদিন তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয় এবং গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এ ধরনের আচরণ অতীতের স্বৈরাচারী শাসনামলে সাংবাদিকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের স্মৃতি উসকে দেয়।

সম্পাদক পরিষদ মনে করে, এ ধরনের চর্চা আমরা অতীতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও প্রত্যক্ষ করেছি। সেই সময় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, হয়রানি ও নির্বিচার গ্রেপ্তার ছিল নিয়মিত ঘটনা। বর্তমান ঘটনাটি সেই দুঃখজনক বাস্তবতারই পুনরাবৃত্তি।

বিবৃতিতে বলা হয়, সম্পাদক পরিষদ এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। একই সঙ্গে পরিষদ স্পষ্টভাবে বলতে চায়—কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, তবে তা অবশ্যই প্রচলিত আইন ও ন্যায়বিচারসম্মত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে। অভিযোগ ছাড়াই ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া, সেখানে আটকে রাখা, কিংবা পরে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাসিনার পতনের পর থেকে বহু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা হত্যা মামলা করা হয়েছে এবং অনেকেই এখনো কারাগারে রয়েছেন।

এ বিষয়ে এর আগেও সম্পাদক পরিষদ তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা মিথ্যা হত্যা মামলা প্রত্যাহারের কথা। সরকারের পক্ষ থেকে আইন উপদেষ্টাও এসব মিথ্যা মামলা ও হয়রানির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়নি। এ ধরনের আচরণ অতীতের স্বৈরাচারী শাসনামলের সাংবাদিক নিপীড়নের স্মৃতিই মনে করিয়ে দেয়। সম্পাদক পরিষদ এ ধরনের আচরণের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে এবং সব ভিত্তিহীন মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে।

  • আনিস আলমগীর
  • রিমান্ড
  • সাংবাদিক
  • #