মডেল তিন্নির আত্মহত্যা : মামলা সম্পর্কিত তথ্য

: অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান
প্রকাশ: ১৫ ঘন্টা আগে

২০০২ সালের ১১ নভেম্বর কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ মডেল তানিয়া মাহবুব তিন্নির অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় আত্মহত্যাজনিত একটি অপমৃত্যুর মামলা রুজু করে। ১৫ নভেম্বর ঐ থানার তৎকালীন এএসআই আশরাফের জবানবন্দি ১৬১ ধারায় রেকর্ড করা হয়।

তাতে জানা যায়- তিনি খবরের ভিত্তিতে ১০ নভেম্বর দিবাগত মধ্যরাতে পোস্তগোলার বুড়িগঙ্গা ব্রিজের নিচের ১১ নম্বর পিলারের বেদীর উপর থেকে একজন নারীর মৃতদেহ উদ্ধার করেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজনের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন যে, একজন অজ্ঞাত পথচারী ব্রিজের উপর থেকে একজন নারীকে নিচে পড়ে যেতে দেখে অন্য পথচারীদেরকে জানায়। ঐ পথচারী আরো জানায় যে, ঐ নারীর বাসা ধানমন্ডি এলাকায়। এতে অনুমান করা যায় যে, পড়ে যাওয়ার আগে (লাফিয়ে পড়ার আগে) ঐ নারীর সাথে উক্ত পথচারীর সামান্য কথা হয়েছিল। যদিও এএসআই আশরাফ ঘটনাস্থলে গিয়ে ঐ পথচারীকে পাননি।

পরবর্তীতে তিন্নির পরিচয় সনাক্ত হলে তার সাবেক স্বামী শাফাকাত হোসেন পিয়ালসহ ৫ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। জিজ্ঞাসানাদ করা হয় চলচ্চিত্র এবং টিভি মিডিয়া সংশ্লিষ্ট ৩৭ জনকে। পিয়াল তার জবানবন্দিতে জানান তিন্নি ছিলেন আত্মহত্যা প্রবন এবং দাম্পত্য কলহের কারণে ইতিপূর্বে পাঁচ বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। তিন্নির ফুপু নার্গিস তাহের তার স্বাক্ষ্যে বলেন যে, ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর ঘটনার দিন বিকালে তিন্নি তাকে ফোন করে নাঈমা নামের তাদের একজন আত্মীয়ার আত্মহত্যার ঘটনার বিস্তারিত জানতে চান। নাঈমা পোস্তগোলার বুড়িগঙ্গা ব্রিজের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে ইতিপূর্বে আত্মহত্যা করেছিলেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় তিন্নি তার কলাবাগানের লেক সার্কাসের ফ্ল্যাট থেকে ফুপুর নিকটবর্তী বশিরউদ্দিন রোডের বাসায় খুবই অল্প সময়ের জন্য এসে ওই বাসার তৃতীয় তলায় বসবাসরত নিজের বাবা ও দাদার সাথে দেখা করেন। এ সময় তিন্নি খুবই বিমর্ষ ছিলেন। তারপর অসমাপ্ত দোতালার এক পাশের ছাদে যেখানে তার দাদিকে মৃত্যুর পরে গোসল করানো হয়েছিল সেখানে গিয়ে সালাম করেন। তারপর দাদার পায়ে সালাম করে ও বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে আবেগঘন বিদায় নিয়ে তিনি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যান। কিন্তু নিজ ফ্ল্যাটে আর ফিরে যাননি। ঐ রাতেই তার মৃতদেহ পোস্তগোলার বুড়িগঙ্গা ব্রিজের নিচে পাওয়া গেলে নার্গিস তাহের নিশ্চিত ভাবে ধারণা করেন যে, মডেল তিন্নি আত্মহত্যা করেছেন। নার্গিস তাহেরের বাসার গৃহকর্মী মহসিন তার জবানবন্দিতে জানান যে, দাদা ও বাবার সাথে দেখা করে তিন্নি ফুপুর বাসার মেইন গেটে এসে তাকে একটি রিকশা ডেকে দিতে বলেন। রিকশায় উঠে তিন্নি নিজের বাসার দিকে না গিয়ে মেইন রোডের (কলাবাগানের মিরপুর সড়ক, সাবেক ধানমন্ডি এলাকা) দিকে চলে যান।

দীর্ঘ তিন বছর তদন্তের পরে ২০০৫ সালে সিআইডি মেমো অভ এভিডেন্সে আত্মহত্যাজনিত কারণে মডেল তিন্নির মৃত্যু হয়েছে এই মর্মে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আবার পুনঃ তদন্ত শুরু হয়। ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে এই মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। যখন অভিযোগপত্র দেয়া হয়, তখন অভি ঢাকায় ছিলেন না। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে রাজনৈতিক নিপীড়ন ও নিজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশংকায় তিনি দেশত্যাগ করেন এবং ২০০৩ সালে কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেন ও সেখানে স্থায়ী হন।

২০১০ সালের ১৪ জুলাই ঢাকার ৭ম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এই মামলায় অভির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। অনুপস্থিত বিধায় ট্রায়াল চলাকালে গোলাম ফারুক অভির নিযোগকৃত কোনো আইনজীবী ছিল না। রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী শাহ ইলিয়াস মডেল তিন্নি আত্মহত্যা করেছেন এই মর্মে মামলাটি খারিজের জন্য বিচারাধীন আদালতে আবেদন করেন। হাইকোর্টের নির্দেশে এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া প্রায় ৫ বছর স্থগিত থাকার পরে ২০১৫ সালে পুনরায় শুরু হয়। ২০১৬ সালের ৩১ অগাস্ট মামলাটি রায়ের জন্য নির্ধারিত ছিল। কিন্তু নির্ধারিত রায়ের তারিখ ৪১ বার পরিবর্তনের করার পরেও আদালত রায় দেয়নি। ১৫ নভেম্বর ২০২১ সালে বিচারক কেশব রায় চৌধুরী স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্য পুনরায় নেয়ার সিদ্ধান্ত জানান।

২০২২ সালে মামলাটির স্বাক্ষ্য পর্ব আবার নতুন করে শুরু হয়। তিন্নির বাসার দুজন গৃহকর্মী, শেফালী আক্তার ও বীনা, ও মামলা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্বাক্ষীরা তিন্নি আত্মহত্যা করেছেন এই মর্মে আদালতে স্বাক্ষ্য প্রদান করেন। আদালতে দেয়া স্বাক্ষ্যে শেফালী বলেন যে, ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর সন্ধ্যার পরে তিন্নি নীল রঙের একটি সাধারণ মানের থ্রি পিস পড়ে তার বাবা ও দাদার সাথে দেখা করার জন্য নিকটবর্তী ফুপুর বাসায় যান, যে বাসার তৃতীয় তলায় তার বাবা ও দাদা ভাড়া থাকতেন। যাবার সময় তিনি তার মোবাইল ফোন বাসায় রেখে যান এবং কেউ ফোন করলে গৃহকর্মীদেরকে ধরতে নিষেধ করেন। নিকট দূরত্বের ফুপুর বাসা থেকে এরপরে তিন্নি আর নিজের বাসায় ফিরে আসেননি। শেফালী তার স্বাক্ষ্যে আরো বলেন যে, তিন্নি প্রায়ই আত্মহত্যা করার কথা বলতেন। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগেও তিনি ৩০টি ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিজ বাসায় আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। খবর পেয়ে তার বাবা সৈয়দ মাহবুবুল করিম ও ফুপু নার্গিস তাহের তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তার পাকস্থলী ওয়াশ করে তাকে সুস্থ করা হয়। অপর গৃহকর্মী বীনাও তার স্বাক্ষ্যে একই তথ্য দেন। ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার জোবাইদুর রহমান তার প্রদত্ত স্বাক্ষ্যে জানান যে, কেউ যদি তিন্নিকে হত্যা করার পরে ব্রিজের উপর থেকে মৃতদেহ নিচে ফেলে দিয়ে থাকতো, তাহলে তার শরীরে মৃত্যু-পূর্ব আঘাত ও মৃত্যু-পরবর্তী আঘাত থাকতো। অর্থাৎ দুই ধরণের আঘাত থাকতো। কিন্তু তার মৃতদেহে কোনো মৃত্যু-পরবর্তী আঘাত পাওয়া যায়নি। তার শরীরে প্রাপ্ত আঘাত মৃত্যু-পূর্ব এবং শরীরের একদিকে; মাথার বাম দিকে ও বুকের বাম দিকে। এই ওয়ান-সাইডেড (একদিকের) আঘাত শুধুমাত্র লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যার ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। মডেল তিন্নি উঁচু থেকে (লাফিয়ে) সরাসরি ব্রিজের পিলারের কংক্রিট বেইসে পড়ার সাংঘর্ষিক আঘাতে সেখানেই মারা গেছেন। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি মোজাম্মেল হক আদালতে তার স্বাক্ষ্যে জানান যে, ৬ বছর তদন্ত করেও হত্যার স্বপক্ষে কোনো স্বাক্ষী কিংবা তথ্য-প্রমান পাওয়া যায়নি।

২০২৫ সালের ১৪ জানুয়ারী তারিখে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ শাহীনুর আক্তার গোলাম ফারুক অভিকে তার অনুপস্থিতিতে এই মামলা থেকে বেকসুর খালাস দেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন যে, মডেল তিন্নির অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে আত্মহত্যা এবং এই মৃত্যুর সাথে গোলাম ফারুক অভির কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। রাজনৈতিক কারণে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এই মামলায় তাকে জড়ানো হয়েছিল।

  • তানিয়া মাহবুব তিন্নি
  • পুলিশ
  • মডেল
  • #