কোটর থেকে বের হওয়া দুইটা চোখ আর আধহাত বের হওয়া জিহ্বা দেখে জ্ঞান হারাল সুলেমান। ফজরের নামাজের জন্য আসছিল সে। তবে মূর্ছা যাওয়ার আগে ও মাগো বলে একটা চিৎকার সে দিতে পেরেছিল। এরপর আর মনে নেই। চিৎকার শুনে মসজিদের মোয়াজ্জিন সালাম হুজুর দৌড়ে বের হয়ে আসলেন। কিছুই খুঁজে না পেয়ে আবার ফিরে গেলেন মসজিদে। ফজরের আজানটা দেওয়া বাকি। খুব সুললিল কণ্ঠে ডাকলেন- হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ। ধীরে ধীরে মসজিদে আরও পাঁচ-ছয়জন মুসল্লি এলেন। মোয়াজ্জিন হুজুরের মুখে চিৎকারের কথা শুনে তারাও বের হলেন টর্চ নিয়ে। বেশি দূর যেতে হল না। হাত পঞ্চাশেক দূরেই মিলল সুলেমানের দেহ। উপর হয়ে পড়ে আছে। গোঙাচ্ছে। তবে ধরে এখনও প্রাণ আছে। চোখে সামান্য পানির ঝটকা দিতেই সম্বিৎ ফিরে পেলেন তিনি। ভয়ে-আতঙ্কে মুখটা পাঙশুটে হয়ে আছে। শুধু আঙুল দিয়ে নদীর পাশের কাশবনের দিকে ইশারা করেই আবার জ্ঞান হারালেন। এরমধ্যেই আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। দুই-তিনজন কাশবনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর যা দেখলেন, তা কারও কল্পনাতেও ছিল না। সুবহি সাদিকের লাল আভায় দেখা গেল অসম্ভব রূপবতী এক তরুণীর নিথর দেহ। হাতে মেহেদি, ঠোঁটে লিপস্টিক আর পরনে নতুন শাড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবরটা সারাগ্রাম চাউর হয়ে গেল। একজন বলল, আরে, এ তো আমাদের সামাদের মেয়ে নীপা। খুব ভাল গান গায় মেয়েটা। কে করলো এই কাজ! খবর পেয়ে নীপার বাবা সামাদ ছুটে এলেন। মেয়ের পাশেই বসে পড়লেন। মাথাটা কোলের তুলে নিয়ে এতটুকুই বললেন এ তুই কী করলি শরীফ? মেরেই যদি ফেলবি তবে ভালবেসে বিয়ে করলি কেন? আমার মেয়েটা তো মা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। পেটে তার পাঁচ মাসের বাচ্চা। এ তুই কী করলি? এরপর যথানিয়মে মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর থানায় মামলা রুজু হল। নীপার স্বামী শরীফকে আর তার ভাবি মর্জিনাকে আসামি করে মামলা দায়ের করল নীপার বাবা। ঘটনার পর থেকেই নীপার স্বামী শরীফ পলাতক। কিন্তু অবশেষে ঠিকই পুলিশের জালে ধরা পড়ল সে। তার ভাবি মর্জিনাও আটক হলো। মাস তিনেক হাজত খেটে বের হয়ে আসে মর্জিনা। পাঁচ বছর হাজত খেটে বের হয় শরীফ। তারপর থেকেই সে পলাতক। আসামির অনুপস্থিতিতেই চলতে লাগল বিচার। যাকে বলে ইন-অ্যাবসেনসিয়া ট্রায়াল। ২০ বছর পর মামলার রায় হল। শরীফের ফাঁসির আদেশ হল। কিন্তু, সে পলাতকই থেকে গেল। ঘটনার এখানেই শেষ। কী, জানতে ইচ্ছে হচ্ছে? কী ঘটেছিল নীপার সঙ্গে? কেন তাকে হত্যা করা হল? নীপার জা মর্জিনা কেন আসামি হয়েছিল? শরীফই বা এখন কোথায়? জানতে হলে পড়তে থাকুন।
সময়টা নব্বই দশকের মাঝামাঝি। ঘটনাটা ঘটেছে মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর থানায়। গ্রামের নাম শিমুলতলী। এই গ্রামের দুই কিশোর-কিশোরী রোজ একসঙ্গে স্কুলে যায়। এপাড়া আর ওপাড়া তাদের বাড়ির দূরত্ব। ভারি ভাব দু’জনের। মানিকজোড়। অনেকটা নাটক-সিনেমার জুটির মতো। একজন আরেক জনকে ছাড়া একদন্ডও একা থাকতে পারে না। বিষয়টা অভিভাবকেরাও জানেন। দুই পরিবারেরই ইচ্ছা বড় হলে বিয়ে দেবেন। এভাবেই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে প্রবেশ করল দু’জন। বলে রাখা ভালো, নীপার গানের গলা অসাধারণ। গ্রামগঞ্জের মেয়ে না হলে রেডিও-টেলিভিশনে গান গাইত নিশ্চিত। কলেজে ওঠার পর নীপার ভক্ত-অনুরাগী বেড়ে গেল। একে তো পুতুলের মতো চেহারা তার উপর গানের গলাও মাশাল্লাহ। এসব দেখে শরীফ বলল, তোমার তো এখন অনেক ডিমান্ড। ক’দিন বাদে তো আর পাত্তাই দিবা না। এ কথা শুনে নীপার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে বলল, এতই যদি ভয় তবে বিয়ে করে ফেলি। সত্যি সত্যিই তারা দু’জন বিয়ে করে ফেলল। প্রথমে পরিবারের লোকজন একটু নাখোশ থাকলেও অল্পদিনের ভেতর তারাও মেনে নিল। তবে বিয়ের পর শরীফ তার স্ত্রী নীপাকে আর পরপুরুষের সঙ্গে মিশতে দিতে নারাজ। তাই নীপার কলেজ যাওয়া বন্ধ হল। নীপা হাসি মুখেই সব মেনে নিল। কারণ, তার কাছে শরীফই সব, শরীফই পৃথিবী। বছর খানেক যেতেই শরীফের বড় ভাই স্বপন মারা গেলেন। রেখে গেলেন এক সন্তানসহ স্ত্রী মর্জিনাকে। মর্জিনার ছোট-খাটো কাজ তাই শরীফই দেখভাল করতে লাগল। এ পর্যন্ত ভালোই ছিল। এর মাঝে এল খুশির সংবাদ। নীপা টের পেল তার শরীরে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে তাদেরই ভালবাসার ফসল। সে খুব লজ্জা আর আবেগ নিয়ে শরীফকে জানাল এই কথা। কিন্তু, শরীফের কোন ভাবান্তর হল না। বরং কিছুটা বিরক্তই হল। বলল, এত তাড়াতাড়ি এসব…।
অল্পদিনেই নীপা টের পেল আগের মতো নীপার প্রতি আর আগ্রহ নাই শরীফের। গানও শুনতে চায় না। এর চেয়ে মর্জিনার প্রতি তার ঝোঁক বেশি। অবশেষে একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে শরীফকে না পেয়ে পাশের ঘরে গিয়ে নীপা যা দেখল, তা আর কাউকে বলতে পারল না সে। লজ্জায় ঘৃণায় তার মরে যেতে ইচ্ছে হল। শরীফ ফিরলে তাকে জিজ্ঞাসা করতেই সে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। যে শরীফ নীপার সঙ্গে জোর গলায় কথা বলে না, সেই কিনা নীপাকে বেদম মারপিট করল। ভোর হতেই রাগ করে বাপের বাড়ি চলে এলো নীপা। নীপার মুখে সব শুনে নীপার পরিবার স্তম্ভিত হয়ে গেল। শরীফের বাবা-মাকে সব কিছু খুলে জানাল। কিন্তু, তারা নীপাকেই দোষারোপ করল। বলল, সে হিংসুটে। সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত। তার ছেলে আর বড় বউয়ের সম্পর্ক হল মা-ছেলের মতো। সুতরাং পৃথিবীর কেউই আর নীপার কথা বিশ্বাস করল না।
এভাবেই কেটে গেল আরও মাস দুয়েক। পেটের ভেতর অনাগত ভালবাসা একটু একটু করে তার অস্তিত্বের জানান দিতে শুরু করেছে। নীপা কাউকেই কিছু বলে না। একা একা গান শোনায় গর্ভের সন্তানকে। হঠাৎই একদিন বলা নেই, কওয়া নেই একগাদা বাজার-সদাই আর নতুন জামাকাপড় নিয়ে হাজির শরীফ। শ্বশুর-শাশুড়িকে সালাম করে বলল, যা হয়েছে তা হয়েছে। আমার পোয়াতি বউ আমি নিয়ে যেতে চাই। এ কথা শুনে, নীপা প্রথমে না না করলেও তার মান ভাঙতে বেশি সময় লাগলো না শরীফের। শরীফ সকলের অগোচরে নীপাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার মস্ত ভুল হয়েছে। মাফ করে দাও। এই কান ধরছি, আর হবে না। শরীফের চটুল কথায় আজন্ম বাঙালি বধূ ভুলে গেল তার সব অভিমান। সে আবার যেতে চায় স্বামীর ঘরে। সে চোখ বুজে দেখতে পাচ্ছেÑ পুরো উঠানে খেলা করছে তার সন্তান। দু’হাত বাড়িয়ে তাকে কোলে নিচ্ছে শরীফ। সে পাশে দাঁড়িয়ে সেই মধুর দৃশ্য দেখছে। খাওয়া দাওয়া শেষে শরীফ বলল, সদরে নীপাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। চেক-আপ প্রয়োজন। খুশিতে নীপার চোখে জল চলে এল। নাহ, শরীফকে ভালবেসে সে ভুল করেনি। শরীফও মানুষ। তাই তারও ভুল হয়েছিল। এবার অন্তর থেকেই শরীফকে মাফ করে দিল সে। বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়ে নীপা চলল স্বামীর সাথে। সদরের বড় গাইনি ডাক্তার দেখাল তারা। আলহামদুলিল্লাহ। ডাক্তার বলেছে গর্ভের কন্যা সুস্থ আছে। খুশিতে নীপা ডাক্তারের হাত ধরে তাকে ধন্যবাদ জানাল। শরীফের মুখেও বাবা হবার লাজুক হাসি। এরপর শরীফ বলল চলো সিনেমা দেখে যাই। প্রথমে নীপা রাজি না হলেও পরে রাজি হয়ে গেল। কেননা রাত যতই হোক, তার স্বামী সাথে আছে। কুচ পরোয়া নেহি। তার দেখল সালমান শাহ-আলীরাজ অভিনীত ‘এই ঘর এই সংসার’ ছবি। বুলবুল আহমেদও আছে। দারুণ সামাজিক ছবি। হল ভাঙল রাত বারোটায়। প্রথমে তারা রিকশায় এল চিকনাই নদীর পাড় পর্যন্ত। এরপর ছোট্ট ব্রিজ। ব্রিজের ওপারেই শিমুলিয়া গ্রাম। রুপালি জ্যোৎস্নায় নদীর পানি ঝিকমিক করছে। আকাশে শুক্লপক্ষের একাদশীর ঝলমলে চাঁদ। চাঁদের আলোয় শরতের কাশফুলগুলাকে শ্বেতবসনা পরীর মতো লাগছে। হঠাৎই শরীফ আবদার করল, নীপা তোমার পছন্দের ঐ গানটা গাও। কনিকা বন্দোপাধ্যায়ের গাওয়া, ‘ দূরে কোথায়, দূরে দূরে…’। শরীফের এমন রোমান্টিক আবদার ফেলতেই পারল না নীপা। কী দারুণ গলা তার। নিঝুম রাত্রির আলোকিত আকাশে অনুরণিত হল তার গলা, ‘দূরে কোথায়, দূরে দূরে…’। গান শেষ না হতেই নীপার গলায় মাফলার দিয়ে প্যাচ দিয়ে ধরল শরীফ। ধরে থাকল শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে। হঠাৎই ব্লিডিং শুরু হল নীপার। বুকটা দু’একবার ওঠানামা করল। তারপর সব শেষ। শুধু মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল একঝাঁক নিশি বক।
তার পরের ঘটনা সকলেরই জানা। শরীফ জামিনে এসে পলাতক হল। কুমিল্লার হোমনাতে গিয়ে নাম পরিচয় বদলে বিয়েথা করে কাটিয়ে দিল আরও ১৫-১৬টি বছর। সেখানে তার ছেলেপুলে হল। কিন্তু, স্বভাব তো তার বদলাল না। পরকীয়া করে ধরা খেয়ে সেখান থেকেও পালিয়ে চলে এল ঢাকায়। পুরান ঢাকায় থাকে আর কাপড়ের ব্যবসা করে। আবারও মিথ্যা পরিচয়ে বিয়েথা করল এখানে। দু-এক বছর যেতেই আবারও পরকীয়ায় জড়াল এক গার্মেন্টস কর্মীর সঙ্গে। এটা জানার পর সংসারে অশান্তি শুরু হল। তাই সে মাঝে-মাঝেই বাসায় না গিয়ে গোলাপ শাহের মাজারে পড়ে থাকা শুরু করল। এখানে সে গাঁজা খায় আর গান গায়। তার খুব পছন্দের গান, ‘ভালবেসে গেলাম শুধু ভালবাসা পেলাম না, আশায় আশায় দিন যে গেল, আশা পূরণ হল না…।’
গল্পের ছলে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় একদিন সে তার কুকীর্তির কথা তার সঙ্গীদের জানাল। খবরটা গোয়েন্দা সংস্থার লোকদের কানেও এল। অবশেষে গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করা হল শরীফকে। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে সে জানালো তার বাড়ি মানিকগঞ্জ। সেই মোতাবেক খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। নীপা হত্যামামলায় আদালত তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করেছেন। আর তার ভাবিকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন।
হাজতখানার সামনে এই নরপিশাচকে দেখতে এসেছে নীপার বাবা-মা। তারা আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ। শরীফের চেহারায়ও যৌবনের ছাপ আর নেই। তবে সেই চেহারায় অনুশোচনাও নেই। নীপার বাবা কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থেকে বলল, আমার মেয়েটার খুব পছন্দের গান ছিল ‘দূরে কোথায়, দূরে দূরে…’। তাই বলে এত দূরেই পাঠায়ে দিলি জানোয়ার? এরপর শরীফের মুখে বার কতেক থু থু ছুঁড়ে দিয়ে তিনি বের হয়ে এলেন। আর কয়েকজন মহিলা পুলিশ পাঁজা কোলে করে নীপার মাকে নিয়ে বের হয়ে এলেন। তিনি বিলাপ করছেন ও নীপা তুই আমার বুকে আয়, আমার বুকের মানিক আমি ফেরত চাই। আমার কলিজা আমি ফেরত চাই…। দূরে, বহু দূরে বসে নীপা এই বিলাপ শুনছে কিনা জানি না। হয় তো স্বর্গের ফুল বাগানে সে তার কন্যাকে নিয়ে আবারও গান ধরেছে, ‘দূরে কোথায়, দূরে দূরে, আমার মন বেড়ায় গো, ঘুরে ঘুরে…।’
লেখক : পুলিশ কমিশনার, কেএমপি, খুলনা