জীবনের আলোছায়া

: আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন  
প্রকাশ: ৬ মাস আগে

কালোতেই নিহিত রয়েছে আলো। কালো না থাকলে আলোর কোনো মূল্য নেই। কালো আছে বলেই সাদাকে সাদা বলতে পারি, আর কালোকে কালো। অন্ধকার আছে বলেই আলোর এতো গুরুত্ব। তেমনি দুঃখ আছে বলেই আমরা এত সুখের কাঙ্গাল। বৈপরীত্যই মানবজীবনের ধর্ম। সময় সর্বদা একইভাবে যায় না, ভিন্নতা আমাদের জীবনেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর একারণেই সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া বা অভিযোজন ক্ষমতা আমাদের সবচেয়ে বেশি। তাই তো মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব।

মানবজীবনের সর্বত্র আলো ও আঁধারের বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। একটির অনুপস্থিতিতে অন্যটির অস্তিত্ব অনুভূত হয় না। আলো ও অন্ধকার দুটি বিপরীত অবস্থা। কিন্তু একটাকে ছাড়া অন্যটার অস্তিত্ব নেই। আলো যতই অনাকাক্সিক্ষত হোক, অন্ধকার না থাকলে আলোর মহত্ব অনুভূত হতো না। আলো ও অন্ধকার একে অপরের পরিপূরক। অন্ধকার না থাকলে আলো দীপ্তিময় হয়ে উঠতো না। তাই অন্ধকার অনভিপ্রেত হলেও অন্ধকারই আমাদের আলোর দীপ্তির মতো শোভার জন্য আগ্রহী করে তোলে।

মানুষের জীবন বড়ই অদ্ভূত! যেখানে আঁকে-বাঁকে ভরপুর বিচিত্রতা। আর এই বিচিত্র জীবনে ঘটে অসংখ্য সব বিচিত্র ঘটনা। হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দের মিশেলে জীবন চলে খরস্রোতা নদীর মতো। কখনও মুক্ত পাখির মতো, কখনও চুপসে যাওয়া ফুলের মতো। মানুষের জীবন তো একটাই। অথচ এ জীবনে কত কিছুই না ঘটে যায়! জীবনের একেকটা মুহূর্ত যেনো একেক রকম মনে হয়। কখনো জমাট বরফের মতো কষ্টগুলো বুকের মধ্যে জমতে থাকে; জীবনটা বড় অসহ্য মনে হয় তখন। মনে হয় এ জীবনের দরকার কী ছিল? আবার কখনো জীবন ভরে যায় অনাবিল সুখ আনন্দে; তখন মনে হয় জীবন কেন এত দ্রুত ফুরিয়ে যায়!

আলোকিত আকাশও কখনো কখনো মেঘে ছেঁয়ে যায়। ঘনকৃষ্ণ মেঘ গ্রাস করে উজ্জ্বল সূর্যটাকে। কিন্তু স্থায়ী হয় না সেই মেঘের বিস্তার। মেঘ কেটে গিয়ে একসময় সেখানে হেসে ওঠে সূর্যবৃত্ত। নিবিড় কালো অমানিশা বিলুপ্ত করে দেয় চাঁদের অস্তিত্ব। কিন্তু এ বিলুপ্তিও সাময়িক। অন্ধকারের বুক চিড়ে আবারও বেরিয়ে আসে জ্যোৎস্নামণ্ডিত চাঁদ। অনাবিল স্বচ্ছতা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মানুষের জীবনও একই রকম। তা কখনো কখনো ঢাকা পড়ে দুঃখ-দৈন্য ও হতাশার মেঘ কিংবা অমানিশার অন্তরালে। দুঃখের শেষে সুখ আসে। তাই সমস্যাসংকুল জীবনে সুখ একদিন আসবেই।

আমরা সর্বত্রই সুখের সন্ধান করি। কিন্তু দুঃখের স্পর্শ ছাড়া নিরবচ্ছিন্ন সুখ লাভ করা যায় না। দুঃখের যন্ত্রণা দেখে আমরা হতাশায় ভেঙে পড়ি, অনেক সময় আক্ষেপ করি, সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ জানাই। কিন্তু দুঃখ আছে বলেই সুখ এত পূজনীয়। বেদনা-হতাশার পর যখন সুখ ও আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়, তার কোনো তুলনা নেই। তেমনি অভাব না থাকলে মানুষের প্রগতি থেমে যেত। আবার চাওয়া-পাওয়া বা অতৃপ্তি না থাকলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এত উৎকর্ষ সাধিত হতো না। জন্মের পর মৃত্যু অবধারিত বলেই জীবন এত মধুময় ও মূল্যবান।

অন্ধকার বা কালোর পেছনে রহস্য কাজ করে। এর ভেতরে আলোর উপস্থিতি বোঝার কথা না অনেকেরই। এই কালো রঙের মধ্যদিয়ে বিভিন্ন বার্তাও পৌঁছে দেয়া হয় সমাজে। খোলা দৃষ্টিতে কালো হলো শক্তিশালী, শোক কিংবা অভিজাত রঙ। এটি সীমানা এবং কর্তৃত্বের রঙ। যদিও কালোর মাধ্যমে নেতিবাচক বহিঃপ্রকাশ হয় বেশি, এর আকর্ষণও কম না। ফ্যাশনের বাইরেও এই রঙ প্রতিবাদের ভাষা বহন করে। আবার অনেক নেতিবাচক বিষয়ের প্রতীক হিসেবে কালো রঙ সামনে চলে আসে। এটি যেমন মৃত্যু, দুঃখ, জাদু, অন্ধকারের প্রতীকী চিহ্নÑতেমনি মার্জিত, সংযম, সম্পদ, শক্তিকেও প্রকাশ করে সমানভাবে। শিল্প-সাহিত্যের বিকাশেও এই রঙের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। কাগজের ওপর প্রথম কালো কালির মাধ্যমেই তো তুলে ধরা হয় শিল্প। কালো পোশাকের গাঢ় ছায়া আমাদের চোখের মণিতেও যেন ধরা দেয়।

বিনয়ী এবং অহংকারী মনোভাব একই সঙ্গে প্রকাশিত এই কালোতে। বলা হয়ে থাকে যারা সব সময় কালো পরতে পছন্দ করেন জীবনের লক্ষ্য তাদের কাছে খুব স্পষ্ট। কালো কারও কাছে আপন, আবার কারও কাছে একটু দূরের রঙ। যেভাবেই কালোকে বিচার করুন না কেন, এটি সব সময় চলতি ধারার রঙ হিসেবেই থাকছে। হারিয়ে যায় না সময়ের গহ্বরে। এ যেন রাতের আঁধারের মতোই। কিছুক্ষণের জন্য সরে যায় আলোর উজ্জ্বলতায়, তবে হারায় না কখনোই। কালো হলো সবচেয়ে সাধারণ কালি রঙ যা বই, সংবাদপত্র এবং নথি মুদ্রণের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি সাদা কাগজের সাথে সর্বোচ্চ বৈসাদৃশ্য প্রদান করে এবং পড়ার জন্য সবচেয়ে সহজ রঙ। একইভাবে, সাদা পর্দায় কালো টেক্সট কম্পিউটারের পর্দায় ব্যবহৃত সবচেয়ে সাধারণ বিন্যাস।

কালো এবং সাদা প্রায়ই ভাল এবং মন্দ, অন্ধকার যুগ বনাম আলোকিত যুগ এবং রাত বনাম দিনের মতো বিপরীত বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়েছে। মধ্যযুগ থেকে কালো গাম্ভীর্য এবং কর্তৃত্বের প্রতীকী রঙ এবং বর্তমানে এটি বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটদের দ্বারা পরিধান করা হয়। নিওলিথিক গুহাচিত্রে শিল্পীদের দ্বারা ব্যবহৃত প্রথম রঙের মধ্যে একটি ছিল কালো। এটি প্রাচীন মিশর এবং গ্রীসে পাতালের রঙ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। রোমান সাম্রাজ্যে এটি শোকের রঙে পরিণত হয়েছিল। ১৪ শতকে এটি ইউরোপের বেশিরভাগ অংশে রাজকীয়, ধর্মযাজক, বিচারক এবং সরকারি কর্মকর্তারা পরতেন। এটি ১৯ শতকে ইংরেজি রোমান্টিক কবি, ব্যবসায়ী এবং রাষ্ট্রনায়কদের দ্বারা পরিধান করা রঙ এবং ২০ শতকে একটি উচ্চ ফ্যাশনের রঙে পরিণত হয়। ২০ শতকের আগে পর্যন্ত বেশিরভাগ পুলিশ ইউনিফর্ম কালো ছিল, যতক্ষণ না তারা ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের কম ভয়ঙ্কর নীল দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গাড়িগুলো প্রায়শই কালো এবং সাদা হয়। কালো আজ সরকারি কর্মকর্তাদের অফিসিয়াল গাড়ির জন্য সবচেয়ে সাধারণ রঙ। কালো আনুষ্ঠানিক পোশাক এখনও অনেক গৌরবময় আয়োজনে পরা হয়। গ্রাজুয়েশন গাউন এবং মর্টারবোর্ডের টুপির রঙও কালো।

আলো-অন্ধকার কিংবা সুখ-দুঃখ নিয়েই মানুষের জীবনপ্রবাহ। যেনো একই মালায় গাঁথা দুটি ফুল। মানুষের ভাগ্যলিপি কেবল সুখ কিংবা কেবল দুঃখ দিয়েই সাজানো নয়। জীবনে কখনো আসে দুঃখের অমানিশা, আবার সেই দুঃখের অমানিশা শেষে আসে সুখের রাঙা প্রভাত। আবার সেই সুখও চিরস্থায়ী নয়। আর এভাবেই দুঃখ-সুখের আবর্তনে আমাদের প্রতিনিয়তই এগিয়ে চলা।

 লেখক : পুলিশ সুপার, নৌ পুলিশ, সিলেট অঞ্চল

  • আলো
  • ছায়া
  • জীবন
  • #