পররাষ্ট্রনীতি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন, পারস্পরিক সহযোগিতার দ্বার উন্মোচন, বিশ্বশান্তি, স্থিতিশীল বিশ্বব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিনিয়োগ, তথ্যপ্রযুক্তির বিনিময়, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক মোকাবেলা, উদ্বাস্তুদের সহায়তা, সুনীল অর্থনীতি, বৈশ্বিক যোগাযোগব্যবস্থার সম্প্রসারণ, পরাশক্তির হস্তক্ষেপ মোকাবেলায় পারদর্শিতা অর্জন আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন মাত্রা লাভ করেছে। এছাড়া প্রবাসী আয় ও রেমিট্যান্স আহরণে বিদেশে দক্ষ-অদক্ষ কর্মী প্রেরণ, বিশ্ববাজারে পোশাকখাতের বাজার সম্প্রসারণ ও নতুন বাজার অন্বেষণ অনেক দিক আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতিতে সংযুক্ত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করেছিলেন- ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’। বর্তমান জটিল বিশ^ব্যবস্থায়ও বাংলাদেশ সে নীতি থেকে একটুও দূরে সরে যায়নি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’-এ মানদণ্ড ঠিক রেখে ভারসাম্যনীতি অক্ষুণ্ন রেখে দেশের বৈশ্বিক অবস্থানকে উন্নীত করতে সচেষ্ট তেকেছেন। কূটনৈতিক সম্পর্কের গুরুত্ব অনুধাবন করে, তিনি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উভয় শক্তির সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে শেখ হাসিনা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিষয়ে বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী অনুঘটক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে কোনো দেশের প্রতি ঝুঁকে নেই। বাংলাদেশের কাছে সব দেশই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতিতে আবদ্ধ। তবে ভারত আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু তাও ভুলে গেলে চলবে না, ভৌগোলিক অবস্থান, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির মেলবন্ধন রয়েছে বাংলাদেশ-ভারতের। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ভারতের অবদান সবকিছুর ঊর্ধ্বে তা নতুন করে বলবার কিছু নেই।
সম্প্রতি ২১-২২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে রাষ্ট্রীয় সফর পরবর্তী নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের করা এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের কূটনীতিতে ভারসাম্যনীতি বিষয়টি আবারো সামনে উঠে আসে। আগামী ৮-১১ জুলাই রাষ্ট্রীয় সফরে চীন গমনের কথা রয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। চীন না ভারত কাকে প্রাধান্য দেবে বাংলাদেশ?
বাংলাদেশ-ভারত শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে একটি রূপকল্প ঘোষণা’ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি ‘ডিজিটাল অংশীদারিত্ব’ এবং ‘টেকসই ভবিষ্যতের জন্য সবুজ অংশীদারিত্ব’ সমন্বিত রূপকল্পকে সামনে রেখে কাজ করছে বাংলাদেশ-ভারত। রেলযোগাযোগ, সামুদ্রিক সহযোগিতা ও সুনীল অর্থনীতি, তথ্য-প্রযুক্তিখাতে সহযোগিতা, স্যাটেলাইট ও সামরিক শিক্ষা সহযোগিতা নিয়ে কাজ করছে এ দুদেশ।
আবার একইভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীন এখন উদীয়মান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। বিশ্বে দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনকেও বাংলাদেশের যথাযথ মূল্যায়ন করতেই হবে। পরিবর্তিত বিশ্বে সবকিছুই খুব দ্রুত পাল্টে যায় রাজনৈতিক হিসাব- নিকাশও তার ব্যতিক্রম নয়। কূটনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা স্থায়ী শত্রু বলে কিছু নেই। তাই আমাদেও পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্যের কূটনীতি আছে বলেই বিশ্বপরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হচ্ছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে যখনই ভারতের কোন সফর, বৈঠক, চুক্তি স্বাক্ষর হয় তখন একটা বিশেষ শ্রেণির লোক অজু করে প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকে কখন তার সমালোচনার জিকির তুলবে। দেশ বিক্রির কলরব তুলে দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করতে সবসময় তারা মরিয়া হয়ে উঠে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, এককোটি শরণার্থী আশ্রয়দান, মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যদের অংশগ্রহণ ও জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরা, বাংলাদেশের বিজয়কে ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা রাখা, তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সৈন্যদের ফেরত নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো কখনই ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। এদিক বিবেচনা করলে ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, আবার একইভাবে নিকটতম প্রতিবেশী। এজনই বিএনপির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান বিএনপির ভারত বিরোধিতার সমালোচনা কওে বলেছিলেন- ‘বউকে তালাক দেওয়া যায়, কিন্তু প্রতিবেশীকে তালাক দেওয়া যায় না।’
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য, ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যসমূহের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আস্তানা হিসেবে বাংলাদেশের মাটি যেন ব্যবহৃত না হয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশীদার হিসেবেও বাংলাদেশ ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য দিন দিন বাড়ছে যা আশাব্যঞ্জক। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গত পাঁচ দশকে এক বহুমাত্রিক পথ পাড়ি দিয়েছে। বর্তমানে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শক্তি ও জালানি, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতির মতো নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বিস্তৃত। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যকার সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ দুটি দেশের সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। উভয় দেশের এ বাণিজ্য সম্পর্ককে আরো নতুন মাত্রায় নিতে আগ্রহী ভারত।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দারুণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। তবে দুই দেশের বাণিজ্যকে আরো জোরদার করার সুযোগ রয়েছে। ভারতে রপ্তানি করার মতো বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনাময় পণ্য রয়েছে, যেগুলো ভারত বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করে। বাংলাদেশ এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাধানে ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। খুব স্বাভাবিকভাবেই তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে প্রশ্ন আসছে বারবার। আন্তর্জাতিক আইনি বিধিব্যবস্থা অনুযায়ী একটি আন্তঃদেশীয় নদী হিসেবে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া বাংলাদেশের অধিকার। ভারতের চাওয়াগুলোর বেশির ভাগ পূরণ হলেও বাংলাদেশের কিছু অপ্রাপ্তি রয়ে গেছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পানির গুরুত্বপূর্ণ উৎস তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির অনিশ্চয়তা দূর হয়নি।
এখন নতুন করে আবার তিস্তা মহাপরিকল্পনার কথা আলোচনায় এসেছে। যেখানে ভারত ও চীন উভয়ই এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কৌশলগত ও ভৌগোলিক দিক থেকে ভারত এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও অর্থায়নের দিক থেকে চীনের সক্ষমতা এগিয়ে থাকবে বলা চলে। তবে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর যদি তিস্তা চুক্তির জন্য আশীর্বাদ হয় তবে তা উভয় দেশের জন্যই মঙ্গলজনক।
প্রতিবেশী কূটনীতিতে বাংলাদেশ-ভারত, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক যত বেশি ভারসাম্যমূলক এবং অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিমুখী হবে, ততবেশি আমাদের দেশের জনগণের আর্থসামাজিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ও জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে। তাই কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায়ের মাধ্যমে ভারত ও চীনসহ বিশ্বের অন্যান্য বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক তা আগামীদিনে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে।
শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে যা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। টেকসই উন্নয়ন, আঞ্চলিক শান্তি বজায় ও বাংলাদেশকে উদীয়মান শক্তি হিসেবে তৈরি করতে শেখ হাসিনার অহর্নিশ প্রচেষ্টা এক অনবদ্য পররাষ্ট্রনীতির সফল বাস্তবায়ন।
শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতি জাতির পিতার রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে অগ্রসর হয়। ন্যায়বিচার, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আঞ্চলিক সহযোগিতার নীতি মেনে চলার মাধ্যমে শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক কূটনীতি এবং মানবিক প্রচেষ্টার প্রচার করার মাধ্যমে শেখ হাসিনা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি শেখ হাসিনার অটল অঙ্গীকার ও তার ভারসাম্যনীতি বাংলাদেশের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে, বৈশ্বিক অঙ্গনে আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে দাঁড়াতে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। উদীয়মান বাংলাদেশ বিনির্মাণে শেখ হাসিনার ভারসাম্যনীতি এক নতুন সৃজনশীলতা, যা দেশের জনগণের কল্যাণে, বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা রক্ষায়- সর্বোপরি বিশ্বমানবতার কল্যাণে রসদ যোগাবে বলে আমি দৃঢ় বিশ্বাস করি।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক