ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টি ভূমিধস জয় পেয়েছে এবং এর অর্থ হলো স্যার কেয়ার স্টারমার দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। নিজের আসনে জয়ের পর স্টারমার বলেছেন পরিবর্তনের সূচনা হলো এখান থেকেই। এটা আমাদের জন্য দেয়ার সময়। সদ্যসমাপ্ত ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন চারজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী। এ জয়ে বাংলাদেশের সবাই অত্যন্ত আনন্দিত এবং গর্বিত। এ চারজন নারী আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন ভিন দেশে প্রতিযোগিতায় নিজ যোগ্যতায় আমরাও জয়ী হতে পারি। তাদের মধ্যে বর্তমানে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের সদস্য রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক, রুপা হক ও আফসানা বেগম রয়েছেন। লেবার পার্টির বিজয়ের সাথে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন তাঁরা। ব্রিটিশ বাঙালি নারীদের এমন বিজয়ে গোটা কমিউনিটি আনন্দে উচ্ছ্বসিত। ব্রিটিশ বাঙালিদের এমন বিজয় বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়েছে এবং নিয়ে যাবে এটাই সবার প্রত্যাশা। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যে ৬ নারী নির্বাচনে লড়ছেন তারা হলেন-টানা তিনবারের এমপি টিউলিপ সিদ্দিক। লেবার পার্টির মনোনয়নে ২০১৫ সালে লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ রেহানার মেয়ে। ২০১৬ সাল থেকে তিনি ছায়া শিক্ষামন্ত্রী, সর্বদলীয় পার্লামেন্টারি গ্রুপের ভাইস চেয়ার, নারী ও সমতা নির্বাচন কমিটির সদস্য-এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন আসছেন। ২০১৫ সালে লেবার পার্টির মনোনয়নে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন রুপা আশা হক। এরপর টানা তিনবার তিনি পশ্চিম লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসনে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। লেবার পার্টির ছায়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ২০১৬ সালে। সর্বদলীয় সংসদীয় মিউজিক গ্রুপের ভাইস চেয়ার এবং ক্রসরেলের সর্বদলীয় সংসদীয় পদে নিযুক্ত করা হয়েছিল তাঁকে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি রুশনারা আলী। লন্ডনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসনে ২০১০ সাল থেকে টানা চারবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।২০১০ থেকে আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক ছায়ামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন রুশনারা আলী। এরপর তিনি ২০১৩ সালের অক্টোবরে ছায়া শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। রুশনারা আলীর জন্ম সিলেটে। বয়স যখন সাত বছর, তখন যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমায় তার পরিবার। তিনি অক্সফোর্ডের সেন্ট জনস কলেজ থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশি-অধ্যুষিত পপলার অ্যান্ড লাইমহাউস আসন থেকে লেবার পার্টির মনোনয়নে দ্বিতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হন আফসানা বেগম। এই আসন থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তাঁর সাবেক স্বামী এহতেশামুল হক। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সোচ্চার ভূমিকা পালন এবং গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে ভোট দিয়ে ব্যাপক আলোচনায় আসেন এমপি আফসানা বেগম। আফসানার জন্ম ও বেড়ে ওঠা টাওয়ার হ্যামলেটসেই। বাংলাদেশে তাঁর আদি বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে। তবে এখানেই থেমে থাকলে হবে না। মূলধারায় আমাদের প্রজন্মকে আরো এগিয়ে নেওয়াসহ প্রতিবন্ধকতাগুলো সমন্বিতভাবে দূর করার সময় এখনই। ব্রিটেনে কনজারভেটিভ পার্টির ১৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে লেবার পার্টির ক্ষমতায় ফিরছে। এবারের নির্বাচনে অর্থনীতিই নির্ধারক ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে দুই দলের কেউই ভোটের প্রচারে অর্থনীতি নিয়ে তেমন একটা কথা বলছে না। এক সময় উদারনৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা ব্রিটেনের অর্থনীতি পরিচালিত হত। মুক্ত বাণিজ্য, ব্যক্তি স্বাধীনতার মতো বিষয় সেখানে প্রাধান্য পেত।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময় এমনটা আর নেই। ব্রিটেনের উদারনৈতিক অর্থনীতি এখন নিয়ন্ত্রিত। হর-হামেশাই রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ হয় এখানে। তবে আগামী দিনে ব্রিটেনের অর্থনীতি কোন পথে চলবে তা নির্বাচনের মাধ্যমেই যে নির্ধারিত হবে সেটি মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির অবস্থা অনেকটা সেই শিক্ষকের মতো, যিনি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সামনে ভালো কিছু বলার জন্য খাবি খাচ্ছেন, কিন্তু বলতে পারছেন না। শিক্ষার মান, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও মূলধন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কর ছাড়সহ নানা বিষয়ে দলটি ভালো করেছে। ৪৫ দিনের টোরি প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের চেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক যথেষ্ট ভালো। সব মিলিয়ে বিগত এক যুগ ধরে দলটি ভালো করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুসহ নানা বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে এই দল। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্থায়ী কাউকে না পাওয়া দলটিকে অনেক ভুগিয়েছে। তবে টোরি পার্টির এই ভালো পৃষ্ঠা উল্টালে যা দেখা যায়, তার তালিকা খুবই দীর্ঘ ও নিষ্প্রভ-জনপরিসর সংকুচিত হয়েছে; কারাগার ভর্তি হয়ে আছে; স্থানীয় সরকারের কাছে পর্যাপ্ত তহবিল নেই। এছাড়া জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা খাত সরকারের জন্য আর্থিক ভাবে ইতিবাচক হলেও সেবা পাওয়াই দুষ্কর। অভিবাসন প্রত্যাশীদের প্রতি টোরি সরকার খুবই কঠোর ও এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় অক্ষম। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার মতো ইস্যুতে এই সরকার খুব বেশি ইতিবাচক আচরণ করতে পারেনি। সবচেয়ে বড় কথা, অবকাঠামো নির্মাণ খাতেও টোরি সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। প্রয়োজনীয় আবাসন সরবরাহে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। বিদ্যুৎ সঞ্চালনে জাতীয় গ্রিডের সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিয়েছে। টোরি সরকারই সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার ইইউ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে ব্রিটেন। ব্রেক্সিটের ফলাফল ইতিবাচক হলেও এর ফলে দলটিতে বিভাজন দেখা দিয়েছে।
যে কারণে, ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়ের প্রধানমন্ত্রীরা তাঁর আগের প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে হয় বাতিল, নয় সংশোধন করেছেন। ব্রিটেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ভোটারদের উপেক্ষা করেছে টোরি। সব মিলিয়ে টোরিদের সাফল্যের বিপরীতে ব্যর্থতা বা শঙ্কার পাল্লা নেহাত কম নয়। এত কিছুর পরও টোরি পার্টির বিলুপ্তি কামনা অন্যায়ই হবে। ব্রিটিশ ভোটারেরা অধৈর্য-অস্থির হয়ে উঠেছেন। এখন লেবার পার্টি ক্ষমতায় এলেও পাঁচ বছর পর ভোটারেরা ফের বিকল্প সন্ধান করতে পারেন। আর ব্রিটেনের রাজনীতিতে সব সময়ই শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি দরকার। ফলে টোরি পার্টি বিপর্যয়ের মুখে পড়লে চরম জনতুষ্টির রাজনীতির দিকে ধাবিত হবে, সেটা তাকে অন্ধকারের দিকেই ঠেলে দেবে। এর ফলে ব্রিটেনের স্বার্থেই টোরি পার্টির পুনরুত্থান জরুরি ছিল। যে দলটির বাজারের প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে। বিরোধী দল লেবার পার্টির যে নেতিবাচক দিক নেই, তা নয়। তারপরও তুলনামূলকভাবে দলটির অনেক কিছুই অন্যদের চেয়ে ইতিবাচক। প্রথমটিই হলো-দলটি অনেক রূপান্তরের ভেতর দিয়ে গেছে। গত জাতীয় নির্বাচনের পর দলের প্রধান কেয়ার স্টারমার জেরেমি করবিনকে বহিষ্কার করেছেন। তাঁর অনেক সহকর্মীকেই ছুড়ে ফেলেছেন এবং দলকে কট্টর সমাজবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে বের করে এনেছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গঠনের পরিকল্পনাসহ লেবার পার্টির অনেক নীতির বিরোধিতা করে দ্য ইকোনমিস্ট। কিন্তু ভোটারেরা যদি লেবার পার্টিকে বেছে নিতে চায়, ইকোনমিস্ট সেটাও সমর্থন করে। দ্বিতীয় আরেকটি ইতিবাচক কারণে ভোটারেরা লেবার পার্টিকে সমর্থন করতে পারেন। সেটি হলো -দলটি জাতীয় প্রবৃদ্ধির বিষয়ে মনোযোগী হয়েছে। ব্রিটেনের স্থবির উৎপাদনশীলতাকে গতিশীল করা ছাড়া আর কোনো কাজই যে এখন গুরুত্বপূর্ণ নয় দলটি তা বুঝে গেছে।
আরও পড়ুন শেখ হাসিনার ভারসাম্যের পররাষ্ট্রনীতি,
এক্ষেত্রে টোরির তরুণ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও শহুরে সমর্থকেরা তাদের মদদ করবে। এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- আরও বেশি বেশি বাড়ি ও অবকাঠামো তৈরি করা এবং ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা। কিন্তু রক্ষণশীল তথা টোরি পার্টি এই বিষয়টি এড়িয়ে গেছে।এখন লেবার পার্টির মাথার ওপর যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো- প্রবৃদ্ধি অর্জনে দলটি কতটা কট্টর অবস্থান নেবে। একপ্রকার খ্যাপাটে ও সতর্ক নির্বাচনি প্রচারণা চালিয়েছে দলটি। তবে প্রচারণার ধরন দেখে মনে হয়েছে, তারা বড় ধরনের পরিবর্তন আনার জন্য জনগণের ম্যান্ডেটের চেয়ে ভোটারদের আস্থায় আনায় জোর দিয়েছে বেশি। তবে এই কৌশল কেয়ার স্টারমারকে খুব বেশি সাহায্য করেছে বলে মনে হচ্ছে। এছাড়া করহার বাড়ানোর বিষয়টি নির্বাচনী প্রচারণায় সামনে না রাখলেও ক্ষমতায় এলে এ কাজটিই লেবার পার্টিকে করতে হতে পারে। বিশেষ করে, শ্রমিক অধিকার, কর বৃদ্ধি, শিল্প খাতে ভর্তুকি হ্রাসসহ নানা কারণে তাঁর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হতে পারে। তবে নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের মাধ্যমে নিজের ও দলের বিরুদ্ধে এসব সমালোচনার কড়া জবাব দিতে পারেন কেয়ার স্টারমার। কোনো বিষয়ে লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়ার ইতিহাস কেয়ার স্টারমারের আছে। ব্রিটেনের স্বার্থে, নিজ দলের স্বার্থে ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেনের অস্থির মতাদর্শিক সময়ে এমনভাবে কাজ করে যাওয়া তাঁর জন্য জরুরিও। সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনার পরিকল্পনা ব্যবস্থার পুনর্গঠন, ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার, স্থানীয় সরকারের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, রাষ্ট্রীয় কোষাগার বৃদ্ধি এবং কর ব্যবস্থা যুক্তিযুক্ত করতে সফল হয় লেবার সরকার তাহলেই ইতিহাসের পাতায় কিয়ের স্টারমারের নাম উজ্জ্বল হয়ে থাকবে এবং ব্রিটেনও আরও ভালো হবে। কিয়ের স্টারমার ও তাঁর দল সেই সুযোগ পেয়েছেন।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট