রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে আজ সোমবার ‘দুর্নীতি ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ-গঠন সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য’ শীর্ষক বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রথম বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. মশিউর রহমানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে আমাদের বিদ্যমান বাস্তবতায় আইনের কঠোর প্রয়োগ সময়ের দাবি, সুবিবেচনার সুযোগ এতে নেই বললেই চলে। গণতন্ত্রের অন্যতম সৌন্দর্য হচ্ছে জবাবদিহিতা। সুতরাং রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক পরিচালনা কাঠামো গড়ে তোলা হলে দুর্নীতি এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। ১৯৭৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে গণভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সকল মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, ডেপুটি মন্ত্রী এবং যে সকল ব্যক্তি এ ধরনের পদমর্যাদা ভোট করছেন তাঁদের নামে ও তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানদের নামে থাকা সম্পত্তির হিসাব বঙ্গবন্ধুর কাছে জমা দিতে হবে। একই বছরের ১৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু সংসদ সদস্যদের প্রতিও এরূপ হিসাব দাখিলের আহ্বান জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ওই দূরদর্শিতা যে কতটা প্রাসঙ্গিক, আজকের দিনেও তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি।
প্রধান বিচারপতি বলেন, কেবল আইন দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা হয় না, দুর্নীতিরও হয় না। এর জন্যে দরকার সচেতনতা, সামাজিক আন্দোলন। সে কারণেই বঙ্গবন্ধু বার বার মানুষের কাছে ফিরে গিয়েছেন, উদ্ধুদ্ধ করেছেন, মিনতি করেছেন, যাতে সমাজের প্রত্যেকটা স্তর থেকে দুর্নীতি বিতাড়নে গণচেতনা বিকশিত হয়। তরুণদের প্রশ্ন করতে হবে তাদের পিতা-মাতার অর্জিত অর্থটা ন্যায়সঙ্গত পথে এসেছে তো? স্ত্রীদের কৌতূহল থাকতে হবে, স্বামীর বিত্ত-বৈভবে অবৈধ অর্থের অংশ নেই তো? বন্ধু পরিজনদের সচেতন হতে হবে, নিকটজনদের উপার্জনটা সঠিক নিয়মে, হচ্ছে তো? এটাই সামাজিত সচেতনতার প্রথম ধাপ। দুর্নীতিবাজ পিতাকে, দুর্নীতিবাজ স্বামী বা স্ত্রীকে, দুর্নীতিবাজ সহকর্মীকে একঘরে করা না গেলে, বয়কট করা না হলে কখনোই দুর্নীতির গভীর ক্ষত সেরে উঠবে না, এ রোগের উপশম হবে না।
বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ তাঁর প্রবন্ধে বলেন, দুর্নীতি বহুল আলোচিত একটি বিষয়। উন্নত-অনুন্নত, গণতান্ত্রিক-অগণতান্ত্রিক সব সমাজে এটি বিদ্যমান। ক্যানসারের মত এটি সম্পূর্ণ নিরাময় করা না গেলেও রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেদে এর মাত্রা বা পরিধি সীমিত রাখা সম্ভব। দুর্নীতির সঙ্গে রয়েছে ক্ষমতার নিবিড় সম্পর্ক। ক্ষমতাবান ছাড়া কারো পক্ষে বড় ধরনের দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। ‘ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিতে প্ররোচিত করে। আর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সর্বগ্রাসী দুর্নীতির জন্ম দেয়’ (লর্ড এস্টন)। দুর্নীতির অর্থ শুধু আর্থিক লেন-দেন নয়, এর সংজ্ঞা বা পরিধি ব্যাপক। যে-কোনো অনিয়ম, অসৎ আচরণ, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়াও দুর্নীতি। বঙ্গবন্ধু দুর্নীতি বলতে তাই বুঝিয়েছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন-পুনর্বাসনের পর বঙ্গবন্ধু রাজনীতির নামে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও চরম বামপন্থীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তাঁর স্বপ্ন পূরণের পথে সবচেয়ে বড় যে প্রতিবন্ধকতার সস্মুখীন হন, তা হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতিবাজদের ‘চোর’ আখ্যায়িত করে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, পাকিস্তানিরা সব নিয়ে গিয়েছে কিন্তু চোরগুলো রেখে গেছে। এদের নিয়ে গেলে বাঁচতাম। তিনি দুঃখ করে এও বলেন, মানুষ পায় স্বর্ণের খনি আর আমরা পেলাম ‘চোরের খনি’।
বিশিষ্ট এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, বঙ্গবন্ধু মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, শুধু আবেদন-নিবেদন কিংবা গুলি করে হত্যা করার মত আইন পাস করেও দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণজাগরণ ও দুর্নীতির উৎসমূলে আঘাত হানা। ১৯৭৫ সালের তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লব বা সিস্টেম চেইঞ্জ কর্মসূচির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল তাই। শীর্ষ নেতৃত্বের ব্যক্তিগত সততা দুর্নীতি দমনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে যে পারে না বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা তারই প্রমাণ। এজন্য প্রয়োজন আইনের শাসন, কোনো দুর্নীতিবাজকে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয়া, বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, স্বাধীন গণমাধ্যম, শক্তিশালী বিরোধী দল, প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান কাঠামো গঠন ও এদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করা। দীর্ঘ ২০ বছর ক্ষমতাসীন থাকায় আওয়ামী লীগের একটি অংশ ও রাষ্ট্র রাজনীতির অন্যান্য শক্তি বলয়ের মধ্যে একটি অলিখিত ‘নেক্সাস’ গড়ে উঠেছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে যা ভাঙ্গা অতি জরুরি।
বঙ্গবন্ধু চেয়ার তাঁর প্রবন্ধে বলেন, জেনারেল জিয়া, এরশাদ, মঈন ইউ আহমদের সেনা শাসন এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি ও পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াতের শাসন আমলে দেশে দুর্নীতির কীভাবে প্রসার ঘটে এবং শাসকগোষ্ঠীর আনূকুল্য লাভ করে তা দেশবাসী সকলেরই জানা। ১৯৮১ সাল থেকে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স এবং ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ করার কথা বলে আসার পরও আজ দেশের সর্বস্তরে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার কীভাবে ঘটেছে সে ব্যাপারে আত্ম-জিজ্ঞাসা এবং দুর্নীতি রোধে নির্মোহভাবে প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত আবশ্যক। অন্যথায়, আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় অর্জন লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে যাওয়া নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার হবে। মনে রাখা দরকার, দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে নিয়ে দুর্নীতি দমন বা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ সময়ের দাবি।’
সভাপতির বক্তব্যে উপাচার্য ড. মশিউর রহমান বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র তাঁর জীবনজুড়ে সংগ্রামের যে নির্যাস তা সংবিধানে সমুন্নত করেছিলেন সেটিই ছিল বাংলাদেশ পরিচালনার আদর্শ। আমাদের প্রতিটি সন্তান সংবিধানের চারটি মূলনীতির কাছে ফিরে যেতে পারলে বাংলাদেশ পৃথিবীর ইতিহাসে নেতৃত্বে আসীন হত এটি আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ভাবাদর্শের সেই চার মূলনীতি মর্মমূলে আঘাত করা হয়েছে। সেই আঘাতের মধ্যদিয়ে আমরা সেদিন পরাজিত হইনি। সেই হত্যার বিচার করা যাবে না মর্মে ইনডেমনিটি জারি করা হয়েছে। সেই ধারায় আমাদের শাসকরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। দীর্ঘদিন অগণতান্ত্রিক, সামরিক শাসনের যাঁতাকলে ছিলাম আমরা। সেই সময়ে ইতিহাস বিকৃতি ঘটেছে। পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছে। একইসঙ্গে দুর্নীতির বিকাশ ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা ফিরে আসার মধ্য দিয়ে ভোট এবং ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রের মুক্তি, সামরিক শাসনের অবসান, অতঃপর ডিজিটাল বাংলাদেশের পথ ধরে স্মার্ট বাংলাদেশে পদার্পন-এর সবকিছু বঙ্গবন্ধুর ভাবদর্শের প্রতিফলন। বঙ্গবন্ধু শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন। দ্বিতীয় বিপ্লবে সমাজ গড়ার প্রধান উপকরণ হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব যদি সূচিত হয়ে তার প্রগাঢ় আলোয় আমরা উজ্জীবিত হতাম তাহলে বিশ্বে বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ায় নেতৃত্ব দিতো। দুর্নীতির মূলোৎপাটন তখনই সম্ভব হবে যখন আমি মুক্তিযুদ্ধকে চিনব, মুক্তিযোদ্ধাদের চিনব এবং সেই বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাকে চিনব যাঁরা নির্যাতন সয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র এনে দিয়েছেন।
সভায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর আবদুস সালাম হাওলাদার। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোল্লা মাহফুজ আল-হোসেনের সঞ্চালনায় সভায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট এবং সিন্ডিকেট সদস্যবৃন্দ, অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরের বিভাগীয় প্রধান, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।