ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে ইরানের জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘আপনাদের সাহচর্য, সহানুভূতি ও আস্থা ছাড়া সামনের কঠিন পথটি মসৃণ হবে না। আমি আপনাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম।’ পেজেশকিয়ানের হাত ধরে ইরানের নতুন যাত্রা শুরু হয়েছে। পেজেশকিয়ানকে বলা হয় সংস্কারপন্থি। এবারের নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর তিনি বিজয়ী হয়েছেন। জনগণ কট্টরপন্থি ত্যাগ করে বেছে নিয়েছে নতুন পথের ইরানের যাত্রা। বলা হয় তিনি পশ্চিমাপন্থি। সুতরাং সে হিসেবে নতুন অনেক কিছুই হয়তো দেখা যেতে পারে। যেমন- সৌদি-ইরান সম্পর্কেও নতুন বাতাস লাগতে পারে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট মিত্র হল সৌদি আরব। ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম দফায় চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে একমাত্র সংস্কারপন্থি প্রার্থী ছিলেন পেজেশকিয়ান। তবে নিয়ম অনুযায়ী, প্রথম দফায় কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়ায় গত শুক্রবার দ্বিতীয় দফার ভোট হয়। প্রথম দফায় প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মাসুদ পেজেশকিয়ান এবং অতিরক্ষণশীল সাইদ জালিলির মধ্যে দ্বিতীয় দফায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়।
এর আগে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম রাইসি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর দেশটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ঘোষণা করে। হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার পর বিশ্বব্যাপী উঠে আসে আলোচনায়। যার বিষয়বস্তু ছিল হঠাৎ এই দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ এবং পরবর্তী প্রেসিডেন্ট যিনি মূলত রাইসির স্থলাভিষিক্ত হবেন। সামনে আসে দুর্ঘটনায় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। যদিও তা শেষ পর্যন্ত টেকেনি। নির্বাচন হয় এবং তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মাসুদ পেজিশকিয়ান। ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জনগণের কাছে একজন জনপ্রিয় নেতা হতে পারবেন কি না সে হিসেব পরে। কারণ ইরানের নেতা হিসেবে রাইসি ইরানে যথেষ্ট প্রভাব বজায় রেখেছিলেন এবং খামেনির পর তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তি। সেই স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন মাসুদ পেজেশকিয়ান। কিন্তু দু’জন দুই মতাদর্শের মানুষ। দেশটিতে গোঁড়ামির কারণে যারা সংস্কারের পথ খুঁজছিলেন তারা এবার তাদের পছন্দের মানুষ বেছে নিয়েছেন। একজন আইনপ্রেণতা হিসেবে ২০০৮ সাল থেকে জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকারকে সমর্থন করে আসছেন পেজেশকিয়ান। ব্যক্তিজীবনে তিনি একজন চিকিৎসক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন। আজারবাইজানি ও কুর্দি ঐতিহ্যের একজন হার্টসার্জন হিসেবে ১৯৮০-৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি শুধু চিকিৎসক দল পাঠাননি, একজন যোদ্ধা ও চিকিৎসক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৩ সালে তিনি ইরানের ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্সেস থেকে কার্ডিয়াক সার্জারির ওপর বিশেষ ডিগ্রি অর্জন করেন। সার্জারির ওপর এই অভিজ্ঞতার কারণে তাঁকে তাবরিজ ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্সেসের প্রেসিডেন্ট পদে বসানো হয়। পাঁচ বছরের জন্য তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সালে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি স্ত্রী ফাতেমি মাজেদি ও এক কন্যাকে হারান।
১৯৯৭ সালে মোহাম্মদ খাতামির প্রশাসনে উপস্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিক হিসেবে তাঁর ক্যারিয়ার শুরু হয়। ২০০১ সালে তিনি পদোন্নতি পেয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হন। ২০০৫ সাল পর্যন্ত সেই পদে দায়িত্ব পালন করেন।রাজনৈতিক ও সামাজিক ভিন্নমতের ওপর সরকারি সংস্থার দমন-পীড়নের সমালোচনা করেছেন তিনি। ২০২২ সালে মাহশা আমিনির মৃত্যুর বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন পেজেশকিয়ান। নারীদের পোশাক বিষয়ক নীতি আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার হওয়ার পর পুলিশি হেফাজতে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুতে ইরানজুড়ে টানা কয়েক মাস অস্থিরতা চলে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, পেজেশকিয়ানকে ভোট দেওয়া অধিকাংশ মানুষই শহুরে মধ্যবিত্ত এবং তরুণ বলে মনে করা হচ্ছে। এরা পরিবর্তন চায়। একটি নতুন ইরান গঠনে ভূমিকা রাখতে চায়। নতুন ইরান কেমন হবে এবং সত্যি কি ইরানকে পাল্টে দেওয়া সম্ভব? বস্তুত একটি দেশের বহু দিনের প্রথা বা সংস্কার হুটহাট বদলে দেওয়া যায় না। সেই চেষ্টা করা বোকামি। সেই চেষ্টা পেজিশকিয়ান করবেন বলেও মনে হয় না। তবে একটি পথ তৈরি করে রাখা সম্ভব। রাইসি ইরানের কট্টরপন্থি নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে পেজেশকিয়ানের ভূমিকা কি হবে সেটা অবশ্য এখনই বলা যাচ্ছে না। যদিও একটি নতুন যুগের শুরু হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। পশ্চিমারা তাকে কিভাবে গ্রহণ করবে সেটাও বিবেচ্য বিষয়। গত কয়েক বছর ধরেই ঝুলে আছে পরমাণু চুক্তিটি। এতদিন একরকম পশ্চিমা রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে গেছে এবং সেখানে রাইসির যথেষ্ট শক্তিশালী অবস্থান ছিল। বলা হয়, তাঁর সাহসী ভূমিকাতেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচি এতদূর এগিয়েছে যা বিশ্বব্যাপী মাথাব্যাথার কারণ। বিশ্লেষকরা বলেছেন, পেজেশকিয়ান ইরানের দ্রুত অগ্রসরমান পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে একটি উত্তেজনাপূর্ণ স্থবির পরিস্থিতি থেকে শান্তিপূর্ণ উপায়ের দিয়ে অগ্রসর হতে পারেন। তুলনামূলকভাবে একজন মধ্যপন্থি এবং প্রেসিডেন্ট থাকা কালে ২০১৫ সালে তিনি বিশ্বের কয়েকটি ক্ষমতাশালী দেশের সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি সম্পন্ন করেন।
(বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভূরাজনীতির পরিবর্তনে পেজেকশিয়ান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। তার হাত ধরেই ইরানের নতুন সূচনা হবে। যা ইরানের রাজনীতি তো বটেই, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। ইরানে যে একটি পরিবর্তন আসবে সেটি নিশ্চিত। তবে সেটি দ্রুত গতিতে হবে না সেটাও নিশ্চিত। তাকে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হবে। সমালোচিত হতে হবে। সেইসব বাধা টপকে তিনি কতটুকু এগিয়ে যেতে পারবেন সেটা দেখার বিষয়)
২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির নবায়ন নিয়ে পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে ‘গঠনমূলক আলোচনা’ করার আহ্বান জানিয়েছেন পেজেশকিয়ান। এই চুক্তির আওতায় ইরানের ওপর আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো শিথিল করার বিনিময়ে পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করতে সম্মত হয়েছিল তেহরান। একইসঙ্গে উত্তেজনা কমাতে সামাজিক উদারনীতি এবং রাজনৈতিক বহুত্ববাদের সম্ভাবনাগুলোকে উন্নত করার উপর জোর দিয়েছেন তিনি। পেজেশকিয়ানের দৃষ্টিভঙ্গি রাইসির মতের সম্পূর্ণ বিপরীত। রাইসি খামেনি আধিপত্যের একজন অনুগত ছিলেন। তিনি খামেনিকে পাশ কাটিয়ে কতদূর অগ্রসর হতে পারবেন সেটাও প্রশ্নের বিষয়। কারণ খামেনিকে এবং কট্টরপন্থি যারা এতদিন মাশা আমিনির ঘটনার মতো ঘটনাগুলোকে সমর্থন করেছেন যেগুলোতে মানবাধিকার এবং বিশ্ব সোচ্চার ছিল সেগুলোতে তিনি পরিবর্তন আনতে চাইলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। জোরপূর্বক যে কিছুই হবে না সেটা নিশ্চিত। একটি জাগরণের মাধ্যমেই সেটি সম্ভব। ইরানের অর্থনীতি ঘিরে আছে নিষেধাজ্ঞা। পরমাণু ইস্যুকে কেন্দ্র করে অনেক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হয়েছে ইরানকে। তাছাড়া সৌদির সাথে সম্পর্কও খুব বেশি সুখখকর নয়। সেজন্য অর্থনীতিকে ফেরাতেও তাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। পেজেশকিয়ান অব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুিিত দিয়েছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভূরাজনীতির পরিবর্তনে পেজেকশিয়ান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। তার হাত ধরেই ইরানের নতুন সূচনা হবে। যা ইরানের রাজনীতি তো বটেই, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। ইরানে যে একটি পরিবর্তন আসবে সেটি নিশ্চিত। তবে সেটি দ্রুত গতিতে হবে না সেটাও নিশ্চিত। তাকে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হবে। সমালোচিত হতে হবে। সেইসব বাধা টপকে তিনি কতটুকু এগিয়ে যেতে পারবেন সেটা দেখার বিষয়।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক