মনজগতের অন্তরধ্যানপ্রবাহে কবির বেদনার স্নানঘরে বিবর্তনের নিদ্রা ভাঙে গল্পের ভেতর অলৌকিক বাস্তবতা উপলব্ধির অদ্ভুত সম্মিলন ঘটে কবির কবিতাগ্রন্থে। স্বপ্নের মাতম পুড়িয়ে জীবন যোজনায় সেই উৎসারণের কবিতা লিখেন কবি লুৎফা শাহিন। তিনি নির্লিপ্ততাকে কখনো নিজের করেননি। কবিতার অন্তর্হিতমানের মর্মকে মান্যতা দিয়েছেন। পৃথিবীর দীর্ঘ পরিতামুখর বিকেলে মাহামুহুরির ধারে শরীর বেয়ে নেমে জীবনের ঢেউ- আবছা আবছা আলোঅন্ধকারে মনে পড়ে কবির গর্ভের দিনগুলি। হয়তো এই জন্যেই হয়তো সেই জন্যেই উষ্ণতার আবেগ আর জলপ্রীতি মানুষের জলমিথ স্পর্শের সাধ এনে দেয় কবি লুৎফা শাহিনের নিরাপদ অস্তিত্বের সংকট সন্ধানের কবিতায়। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে কালেরচক্রে প্রায় অবলুপ্ত তপ্তনদীর বালুচর কবির কবিতায় মহাকাল পৌঁছে যায় কবিতাবলি ‘হৃদয়প্রণিতজোছনা ওড়ে মাতামুহুরিরজলে’ বইমেলা-২০২৪ এ পুণ্ড্রু প্রকাশন থেকে প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থে। এই গ্রন্থে মোট ৪৪টি কবিতা মুদ্রিত হয়েছে।
কবিতার ঘোরের ভেতর স্থির সময়ের অস্থিরভাবনা হতে চোখের অন্ধকার আলোয় লুকিয়ে আছে। সেই ঘোর থেকে ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছে একটি কচিপাতা, মুহূর্তের রঙ, হলুদ থেকে কালচে শাদা আবার শাদা থেকে কী এক রঙ- বুঝে ওঠা যায় না। শুধু কবির ভাবনায় দেখা যায়- অন্ধকার সরে আসছে, চোখের কালো দাগগুলো মুছে যাচ্ছে আগের অবস্থানে। যেখানে কবি হলুদ ফিকে রঙ মিশিয়ে গুলতি অজগরের মতো প্যাঁচিয়ে ধরে শব্দের উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। কবির কবিতায় মানবিক বিপর্যয়, অস্তিত্ব সংকট, সমাজ-জাতি ইত্যাদি অনুষঙ্গ বিষয় করে কবিতা ফুটে উঠেছে। বিদেহী শব্দের আত্মা, শব্দের জান্তব লাশ স্বরে-বিস্বরে স্বাধীন হবার ব্যাকুলতায় অন্তিম ইচ্ছেরা ঘুমুতে দিচ্ছে না কবিকে নিবিড় শূন্যতায়।
তার কবিতাপাঠে আমরা মনের এক বিশার ব্রহ্মা পার হতে হতে কবির অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেকে রূপান্তরিত করছি এক চিন্তাবিশ্বের মনোট্রেনের যাত্রী হিশেবে। আলোচনার সঙ্গতি রক্ষার্থে আমরা কবির কবিতা পড়ি- ‘সমুদ্রশিয়র থেকে চোখের সূর্যে ভোর হলো আশ্রয় স্বপ্নের…/ সব বোঝার আশ্চর্য কেমিস্ট্রির অন্তর্গহনে আর স্বরচিত মনন স্বাচ্ছন্দে ছেড়ে দিলাম তোমাকে, বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে! বিরহমান এইজলে সর্বত্রই অমিত লাবণ্যমেঘ/এখন বড় হয়ে ওঠা দূরগ্রামী দৃশ্যরা জেনে নিক আমাদের মেজাজি কাব্যভাষা অধুনাচিন্তার কথোপকথন (দুরগামী দৃশ্যের কথোপকথন,পৃ-১১) কবির এই কবিতায় পাঠক দৃশ্যের ভেতর অর্ন্তগত হয় এক অলৌকিক চেতনায়। আবার ‘বেদনার চোরাবালিতে পা রাখবো না ভেবে/ কতো সময় কেটে গেলো জীবননদীতে-/জানি- তবুও পৃথিবী একদিন ঘুড়ে দাঁড়াবে-/ আমরা বহিরাবরণ বেঁচে থাককো কোনো এক স্নানঘরের বেদনার সমুদ্রে (স্নানঘর, পৃ-১৪) কবি প্রেম-ভালোবাসা আর আশ্রয় খোঁজেন প্রিয়জনের অনুভূতিতে-‘অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে একদিন সমস্ত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে আমাদের দেখা হলো../ তোমার চোখে-মুখে আর হৃদয়ের বসতবাড়িতে আমার কতোখানি জায়গা! আমার বিশ্বাসের ঠিকানা তুমি আর আমি তোমার হৃদয়প্রণিতজোছনা জীবনের মধুময় আলো!’ (প্রথম অনুভূমি, পৃষ্ঠা-২০) কবিতা কিন্তু অন্তরের মস্তিষ্কে উপাদানে বিভিন্ন চেতনায় ধর্মান্তরিত হয়। কবির চিন্তাগুলো অর্থবহ প্রেরণায় অন্তরবিহ্বল অনুভূতিতে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে অন্যভাষায় অন্য ট্রান্সমিশনে।
কবি যখন বলেন- ‘জীবনের দীর্ঘপথ হেঁটে এসে ইশারা ঝড় প্রসঙ্গ বদলে দিলো/অমীমাংসিত ধারণার বাতাস‘ (বিবর্তনের নিদ্রা ভেঙে,পৃ-১৯)। আবার- ‘মলিন দিগন্ত- ফুঁফিয়ে উড়ছে আকাশে মাতাল সময়ে’(ছল-চাতুরির করতলরেখা, পৃ-৩৪)। কবি কীভাবে সমাজ,তথাকথিত জীবনব্যবস্থা, আমাদের কলুষিত সময়কে নাড়িয়ে দিচ্ছে তার চেতনার মর্মমূলের ইশারার শক্তিকে স্পর্শ করে। কবি দেশ, রাজনীতি, আদরের ছোটোবোনসহ জন্মদাতা, প্রেম সর্বোপরি কবি এবং প্রিয়জনের সান্নিধ্যলাভের অনুভব-অনুভূতি কবিতায় মাত্রাদান করেছেন। লুৎফা শাহিন প্রথম দশকের কবি তবে দীর্ঘদিনের কবিতা সাধনা তার। আধুনিকতার সাথে এক ধ্রুপদি মেজাজের মিশেলে কবি হেঁটে চলেছেন ইতিহাস আর বর্তমানের অলিতে গলিতে। ‘একাকিত্বের মহাবাতাসের ফেনা উড়িয়ে নতমুখ ঘোড়া দাপাচ্ছি কঠিনকে ধারণ করে/আর স্বরচিত কারাগার তৈরি করছি নিজেই বন্দি হতে’ (উৎকর্ণের এককিত্ব,পৃ-৩৮)।
বিশসংস্কৃতিতে যেসব শতাব্দী-উচ্চ ঢেউ আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির বেলাভূমিতে নতুন ঢেউ দোলা দিচ্ছে নাড়িয়ে দিচ্ছে লুৎফা শাহিনের কবিতা। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মার্জিত দুরুহ শব্দ এবং জীবনানন্দ দাশের তীব্র জটিলতর ভাবনার ব্যঞ্জনা শাহিনের কবিতায় নেই। বরং অন্তর্গহনে আছে শরীর আর আত্মার অভিনব কেমিস্ট্রি। এই কবি এ সময়ের কবিতা লিখেন, পুনরাধুনিক কবিতার ফর্ম আর দ্যোতনায় রচনা করছেন কবিতাবলি। লক্ষ্য করা যায়- কবি ভাষা-শব্দকে আরোপিত করেননি বরং নিজ ভাষা ও শব্দে ভর করে নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে পোঁছতে চান পাঠকের কাছে। হরিণের পাজর খুলে ওঠে দৃশ্যায়নের জোছনাভরা চাঁদ- যেনো মুক্তোদানার মতোন শিশিরবৎ প্রাণসত্তায় এই ক্ষণবিহারি ঝিলিমিলিই কী এই নিশ্চিহৃজলের শেষ ঠিকানা, শেষ পরিচয়! আমরা জানি বিশ্বপ্রকৃতির তন্ময় বিস্তারে জন্ম আর মৃত্যুর অধিকার ধারণ করেছে মানবতার মায়াবী ও অবিনাশী অক্ষর লিপিবদ্ধ করছে কবির অন্তরপ্রকৃতি। যেখানে অতীত-ভবিষ্যতের বেলায়, অনাগতকালের গভীরে-সংগুপ্ত! তাই কবির প্রত্যয়- বৃক্ষের শরীরে কতো অনাগত সম্ভাবনার বীজ। প্রতীকী মাতামুহুরিজলে স্থলে মাটির দৃষ্টিগম্য ভাবিবিশ্বের উজ্জ্বল রূপস্বপের আয়ুগাঁথা।
সেই প্রবাহিত নদীর ভেতর দিয়ে বর্তমান সময়খণ্ডের কিনারে এসে ভেড়ে নানাধরণের বোধ ও প্রতীতী। এর পাড়ে এর ধারেই গড়ে ওঠে যাপিত জীবনের বহুচিত্র এবং লোকসংস্কৃতি কিংবা লোকবিশ্বাসের প্রচলিত অনেক কাহিনি। সাংস্কৃতিক মোহনায় মানুষের সামগ্রিক জীবনব্যবস্থার চিত্র, মনোবাসনা, স্বপ্ন, ইচ্ছে, ভাব ও ভাবনা, যা গ্রন্থিত কবিতায় জড়িয়ে আছে নানা ভঙ্গিমায়।
‘বোধের সব উন্মুখ জানালা খুলে রেখেছি আকাশে’ (নির্ভরতার চন্দ্রোৎসব, পৃ-৪২) এরকম দৃঢ়তাসম্পন্ন বাক্য অন্তরের সহজিয়া প্রবৃত্তি জাগিয়ে তোলে। আমরা কবির সিগনেচার নিশ্চিত করতে তার গ্রন্থশিরোনামযুক্ত কবিতাটি কিছুটা তুলে ধরি- ‘পাখিরা এঁকেছে আকাশের মুক্ত তারার সোহাগিরোদ, সোনালিধানের শীষের দোলায়িত ধু-ধু বালুচর, রক্তাক্ত কুয়াশায় ঢাকা দূর্বাঘাসের পাড় নদীর কিনার কিংবা জলের ঈশ্বররিমিথ। ..হাজার দুয়ারির ফেলে আসা স্মৃতির বাগানে ময়ূরপঙ্খির মতো নৃত্যে খেলা করে মাতামুহুরির বালুচর..মাতামুহুরি আমাদের যৌবনমত্ত প্রাণের চোখে আঁকা অনাতিকালের ইতিহাস..অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমির তীরে মাতামুহুরি ছড়িয়ে আছে প্রিয় চকোরিয়ার অনিন্দ্য জীবন প্রচ্ছদে- ’ভালোবাসা আর সৌন্দর্যবোধ আমাদের পরিশীলিত করুক যাপনের কৃষ্ণ বুকের চাতালে! কবি লুৎফা শাহিন সবার হৃদয়ে জোছনা উড়িয়ে পাঠকপ্রিয়তাকে ছুঁয়ে যাবে- এই শিহরণ প্রত্যয় রাখা যেতেই পারে।